#১৩(শেষ পর্ব)

#প্রাপ্তি

#১৩(শেষ পর্ব)

পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে।

রশ্নী যেমনটা ধারণা করেছিল,তেমনটা হয়নি,বরং তার চেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছে পূজা হত্যা ঘটনাটি। এটি শুধুমাত্র এপাড় বাংলা নয়,ওপাড় বাংলাও কাঁপিয়ে দিয়েছে সমানভাবে।

'অনার কিলিং' বা 'শেম কিলিং' বর্বরতার এক অনন্য ব্যবস্থা যার কার‍ণে পরিবারের সদস্যরা ধারণা করেন, পরিবারের ঐ সদস্যের হত্যার মাধ্যমে তাদের সম্মান পুনঃরায় স্থাপন হয়। রশ্নী এ ব্যাপারে পড়াশোনা করার পর অবাক হয়ে গেছে। এর উৎপত্তি প্রাচীন রোমান রাজ্য থেকে যেখানে একটি পরিবারের সকল সিদ্ধান্তের ভার ছিল পুরুষের উপর। কখনো কোন কর্ম দ্বারা যদি মনে করা হত পরিবারের প্রতি অসম্মান ডেকে আনা হয়েছে,হোক তা বিবাহে অমত পোষণ কিংবা বিবাহ বহির্ভূত কারো সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে, পুরুষের পূর্ণ অধিকার ছিল তাকে হত্যা করার। মূলত এটি একটি মধ্যযুগীয় সামাজিক শাসন ব্যবস্থা। প্রাচীন চায়নাতে রাজা দাইনাস্তির শাসনামলে এই হত্যার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে আইন ছিল। খুব বেশি দিন আগের কথা না, আফগানিস্তান, পাকিস্তানেও এ ধরণের হত্যা আইনত স্বীকৃত ছিল। অল্প কিছু দিন,হয়ত কয়েক দশক হবে ওসব দেশে অনার কিলিং এর বিরুদ্ধে সরকার সোচ্চার হচ্ছে। ২০১১ সালে লেবাননে এই হত্যাকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এরপরও জার্মান, সুইজারল্যান্ড, আলবেনিয়া, ইটালি,ভারত,পাকিস্তান, ব্রাজিল, মিশর, ইকুয়েডর, ইজরায়েল, ফিলিস্তিন,জর্ডান, ব্রিটেইন, সব যায়গায় এই অপরাধে অপরাধীরা লুকিয়ে আছে। পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে আজও হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষেরা মারা যায়।

অনেক সময় আবার ভিক্টিমকে জোরপূর্বক আত্মহত্যায় বাধ্য করা হত যা মূলত পূজার বেলায় ঘটেছে। আত্মহত্যা করতে বলা হয়েছিল পূজাকে,নিজ হাতে কাটতে বলা হয়েছিল হাতের রগ।পূজা তা করতে না পারায় রাজীব এসে ওর হাতের রগ কেটে দিয়েছে। পূজা ডান হাতি ছিল আর হাতের রগও কাট ছিল ডান হাতের। সাধারণত ডান হাতি মানুষের বাঁ হাতে কাজ করার কথা না।এইটুকু ধারণা রশ্নীর শুরুতেই ছিল। পরবর্তীতে শিখা এই কথা কোর্টে জবানবন্দিতে জানায়।

নিজের পরিবারের কাছেও অনেক সময় মানুষ বড় রকমের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়; পূজা মন্ডল ও তার নিষ্পাপ কন্যা এর প্রমাণ। রশ্নীর সাহসিকতার কারণে পূজার পরিবারকে আইনত সাজা দেয়া সম্ভব হয়েছে। রাজীব আর শিমুল মন্ডলকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছে। প্রমাণের অভাবে অন্যান্যদের কিছু করা যায়নি। রশ্নী খুশি, অন্তত নিজের ঝোঁকের বশে হলেও একদল খুনিকে সে আইনের আওতায় এনেছে! ওর এই সাফল্য উদযাপন করার জন্য তুহিন,মাশরুক,নওশাবাসহ আরো বেশ কিছু প্রিয় মুখ ওর বাসায় এসেছে। আজকে সেলিব্রেশন হবে!

রশ্নী ছোট্ট আয়োজনে ছোট্ট পরীকে জড়িয়ে নিয়ে সবার সামনে আসে; পরনে লাল শাড়ি কালো পাড়,কালো ব্লাউজ, চুল গুলো কাঁধের দুপাশে ছড়ানো,কানে বড় এক জোড়া ঝুমকা,গলায় পাতলা চেন। ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে সে সবার সামনে এসে হাজির হয়। ওর আগমনে সবাই অভিনন্দন জানাতে এগিয়ে আসে। সবাই শান্ত হয়ে বসার পর রশ্নী উঠে দাঁড়ায়। সকলের উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলার জন্য বসার ঘরের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে গলা খাকরি দেয়।

"আজ আপনাদের সবাইকে চারটে খুশির সংবাদ দেয়ার জন্য ডেকেছি। প্রথম খুশির সংবাদ আপনারা জানেন, আমি পূজার খুনিদের বিচারের আওতায় এনেছি। সাংবাদিক হিসেবে নয়,একজন মানুষ হিসেবে আমি একটা সামাজিক অপরাধের বিরদ্ধে লড়েছি যাতে আপনারা সবাই আমাকে সাহায্য করছেন। এই অর্জন শুধু আমার নয়,এই অর্জন আপনাদের সবার।

দ্বিতীয় খুশির সংবাদটার জন্য আপনাদের মাঝের একজন ভীষণভাবে দায়ী। আমি এক মাস আগেও ভাবিনি এমন কিছু হবে। প্রথম দিকে এই ছোট্ট পরীকে নিয়ে আমি খুব হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলাম। ওকে সার্বক্ষণিক খেয়ালের জন্য একজন মানুষ রেখেছিলাম যা যথেষ্ট না। এত ছোট বাচ্চার জন্য কোন কাজের মানুষ একা যথেষ্ট না।এদিকে ওর কয়েকদিন পর একেকটা অসুখ হচ্ছে।দিশেহারা আমি যখন ওকে নিয়ে উত্তাল সমুদ্রে একা একা হাবুডুবু খাচ্ছি,তখন একজন হাত বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে।

ঐদিন আমি নিজেও বেশ অসুস্থ ছিল। অফিসে কোনোভাবেই যেতে পারিনি।এদিকে আমার কন্যার সারা রাতভর কান্না আর কান্না! ঐদিন অনুভব করেছিলাম,একটা বাচ্চার শুধু মা না,বাবাকে প্রয়োজন। হয়ত ওর বাবা থাকলে আজ ওকে কোলে নিয়ে রাখতে পারত,বুকে জড়িয়ে ধরতে পারত, আমাকে একা একা সবটুকু করতে করতে হত না। সেদিন প্রথম খুব মনে করে উপলব্ধি করছিলাম, একজন নারী আর একজন পুরুষ, এরা একে অপরের পরিপূরক। আমার জীবনে আমার পরিপূরক,বা বেটার হাফকে খুঁজে পাওয়ার সুযোগ পাইনি বলে আফসোসও হচ্ছিল।

জানিনা কেমন করে যেন আমার অসম্পূর্ণতা পূর্ণতা পাবার প্রয়াশ পেল ঐরাতেই! আমার বাসায় ঐ মানুষটা হুট করেই হাজির। মেয়েকে নিয়ে হতবিহ্বল অবস্থায় দেখে এগিয়ে আসে। আমাকে জোর পূর্বক গোসল আর খাবারের জন্য পাঠিয়ে এক হাতে ওকে সামলায়।আমি অবাক হয়ে দেখি, পুরুষ মানুষ এমনও হয়? এতটা ভালো বাসতে পারে?

যখন আমার পরী ঘুমিয়ে পড়ল, স্নিগ্ধ চাঁদের আলোয় নিয়ে সে আমার দুহাত জড়িয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে বলল, এই মাঝ সমুদ্র থেকে সে আমাকে উঠাতে চায়,সে চায় আমার পাশে পাশে হাঁটতে, কারণে অকারণে আমার হাতটুকু নিজের হাতের মুঠোয় নিতে, গভীর রজনীতে ঘুমের মাঝে আমার ঘুমন্ত মুখখানা দেখতে। আমার একাকী জীবনে সে এই ছোট্ট পরীর পাশাপাশি নিজে আরেকটা ছায়া হতে চায়। ছোট্ট পরীর মা আমি,সে এই ওর বাবা হতে চায়!

প্রথমে ভেবেছিলাম এটা দুষ্টুমি।এত দিনের পরিচয়ে এটুকুও বুঝিনি কেন যে আমাকে নিয়ে তার চোখে স্বপ্ন খেলা করে? কেন বুঝিনি আমাকে নিয়ে তার বুকের ভেতর মাঝরাতে ভীষণ ঝড় ওঠে? আমার পরীর বাবা সে হতে পারে,এইটুকু কেন বুঝিনি? নিশ্চয় কোথাও ভুল হচ্ছে!কিন্তু না। তার নেত্র জোড়া আমাকে জানাল, মিথ্যার কোন আশ্র‍য় ওর মাঝে নেই।আমি সেদিন হাত না বাড়িয়ে পারলাম না। এমন এক হাত আমি কি করে হারাই?"

নওশাবা উৎসুক মুখে বলে ওঠে,
"তোর সেই ভাগ্যবান জোড় কোথায়! একটু আমাদেরও তার মুখদর্শন করা!"

রশ্নী স্মিত হাসে,ওর হাসি দেখে তুহিন এগিয়ে এসে ওর পাশে দাঁড়ায়,ডান হাতটা নিয়ে তার উপরপৃষ্ঠে চুমু খায়। সবাই বুঝতে পারে,রশ্নীকে এই বয়সে ভালোবাসায় গলিয়ে ফেলা মানুষটা তুহিন! খুশিতে সকলে হৈহৈ করে ওঠে।আর রশ্নী হয়ে যায় লজ্জায় অবনত। সবার সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষকে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলে যে এরকম মরো মরো ভালো লাগা সমস্ত শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে,তা কি আগে কখনো জানত? আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে সবার মাঝে।

মাশরুক এবার ভ্রু নাচায়।
"তৃতীয় সুসংবাদটা কখন দেবে?"

রশ্নী তুহিনের মুখের দিকে একবার চায়,তারপর সবার মুখে একবার চোখ বুলিয়ে হেসে বলে,
"তৃতীয় সুসংবাদটা হল আমরা অল্প কিছুদিনের মাঝেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছি!"
"তোমার পরিবারের মতামত কি?"
"আমার পরিবার অবশ্য এতে আপত্তি জানিয়েছে"
"কেন?!"
"অনেক কারণ আছে। তারা চায় তাদের পছন্দের কাউকে আমি বিয়ে করি। এটা সম্ভব না।যাই হোক! আমি মনে করি,আপনারা সবাই আমার পরিবার। যারা আমার খারাপ সময়ে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছে,তাদের আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়ে সুখী হতে চাই।"

নওশাবা রশ্নীকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায়,
"অনেক বেশি সুখী হ বোন! অবশেষে তোকে এভাবে দেখে আমার যে কি শান্তি লাগছে! আচ্ছা... শেষ গুড নিউজটাও নাহয় দিয়ে দে?"

"চতুর্থ এবং সর্বশেষ সুসংবাদ হল, আমরা আমাদের ছোট্ট পরীর নাম ঠিক করেছি।"

সবার উৎসুক কান শুনতে চাচ্ছে ওর নাম। তুহিন ছোট্ট পরীকে নিজের কোলে নিয়ে এক হাতে রশ্নীর কাঁধ জড়িয়ে বলে,

"প্রাপ্তি!"

লেখনীতে, #AbiarMaria

সমাপ্ত

N:B: All information source of "honour killing" is from Wikipedia, BBC report, UN report.

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top