#১২
#প্রাপ্তি
#১২
রশ্নী চোখ পিটপিট করছে। মাথার ভেতরটা মনে হচ্ছে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, ভেতরের রগগুলো দপদপ করছে। অনেক কষ্টে ইচ্ছার ব্যাতিরেকে চোখ খোলে,সবকিছুই অস্পষ্ট। ধীরে ধীরে দৃশ্যপটে সবকিছু ফুটে ওঠে; চোখের সামনে থাকা মুখটা চিনতে এখন আর কষ্ট হচ্ছে না, তুহিন। ছেলেটা উদ্বিগ্নতা নিয়ে মুখের দিকে চেয়ে আছে। রশ্নী অনেক কষ্টে বলে,
"পানি..."
মাথার উল্টো দিকে দাঁড়ানো মাশরুক পানির গ্লাসটা এগিয়ে দেয়। কোনোমতে ঘাড় তুলে পানিটুকু দিয়ে রশ্নী গলা ভেজায়। পানি পানের পর মাথাটাও কিছুটা ভারমুক্ত লাগছে। ধীরে ধীরে শব্দগুলো উচ্চারণ করে,
"আমি কোথায়?"
"হাসপাতালে। কপালগুণে হাসপাতালে!"
"মানে?"
ওপাশ থেকে মাশরুক গলা পরিষ্কার করার জন্য কাশি দেয়,
"মানে ইউ অয়ের ড্রাগড"
"হাউ! আমার...উফ,মাথা ব্যথা করছে খুব। আমার কিছুই মনে আসছে না।কি হয়েছিল?"
"বলছি। শিখার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে পূজার সত্য জানার জন্য,মনে পড়েছে?"
রশ্নী এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ায়।
"আমি একেবারে কিছুই মনে করতে পারছি না"
এসময় ডক্টর আর একজন নার্স কেবিনে প্রবেশ করেন।ওদের কথা বলতে দেখে বলেন,
"বাহ,উনি দেখি উঠে গেছেন।খুব শীঘ্রই ঠিকও হয়ে যাবেন আশা করছি।তবে পেশেন্টের সাথে এখন বেশি কথা বলা যাবে না,তার ব্রেনের উপর কোন প্রকার চাপ দিবেন না"
তুহিন মাথা নাড়ায়,
"আচ্ছা,এখন এত প্রেশার নিতে হবে না,ধীরে ধীরে সব মনে পড়বে।ব্রেনে চাপ নিলে হিতে বিপরীত হতে পারে,ডক্টর তো বললই। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও,তারপর আমরা কথা বলব"
আধাঘন্টা পর রশ্নী যখন খানিকটা ধাতস্থ হয়,মাশরুক আর তুহিন মিলে সেসব বর্ণনা শুরু করে। রশ্নী কিছু স্মৃতি ঝাপসাভাবে মনে পড়ে,কিছু একেবারেই মনে করতে পারে না।মাশরুক রশ্নীকে বলে,
"ভাগ্যিস আমি শিখা আর তোমার প্রতিটা কথা রেকর্ড করেছিলাম এই রেকরর্ডারটা লাগিয়ে।নাহয় শিখার স্টেটমেন্ট সব তো হাওয়া হয়ে যেত!"
রশ্নী দেখে মাশরুকের হাতে ছোট একটা চতুষ্কোণ কালো যন্ত্র।
"কোথায় ছিল এটা!"
"তোমার শার্টের পকেটে,তোমার অজান্তেই ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। শুধু তাই না,আমার বাহিনীকে দয়ে ওদের সিসিটিভির ফুটেজও সংগ্রহ করেছি। সাথে শিখাকেও থানাতে নিয়েছি"
"তার মানে শিখাই আমাকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল?!"
"না,শিখা দেয়নি, শি হেজ বিন ফলোড"
"বাই হুম?"
তুহিন বলে,
"বাই হার ব্রাদার। শিখা যখন আসছিল,তখন ওর পেছন পেছন দুটো কালো হুডি পড়া লোক এসেছিল।আমি তখন নিচ তলায় গিয়েছিলাম হাত পা ঝাড়া দিব বলে। তখনও বুঝিনি এই সেই আগন্তুক।উপরে তোমার সাথে দেখার পর বুঝলাম বড়সড় ঘাপলা আছে এতে।মাশরুক ভাইকেও তখন সতর্ক করে দিলাম।ওরা তোমাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল,তাই ওয়েইটারকে হাত করে ওতে ঘুমের ওষুধ দিয়ে দেয়।"
মাশরুক পাশ থেকে যোগ করে,
"তোমাকে যেটা ওরা দিয়েছে,সেটা কিন্তু স্বাভাবিক কোন ঘুমের ওষুধ না।এটার নাম হল রোহিপনল।এর আরো অনেকগুলো নাম আছে যেমন- রুফিছ,আর-২। এই ওষুধের বাজে ব্যাপার হল এটা যাকে খাওয়ানো হবে সে শুধু ঘুমাবে না,তার স্মৃতিও নষ্ট হবে,অন্যদিকে কনফিউজড হয়ে থাকবে। এটা পুরোপুরি কার্যকর হতে আধাঘন্টার মত লাগবে,এজন্য তুমি অনেক কিছুই বলে ফেলেছ লেমোনেড গিলে ফেলার পরও। অনেক সময় শ্বাসকষ্টও হতে পারে যা তোমার হয়নি। তবে তোমার ডানপাশ নাড়তে সমস্যা হচ্ছে।"
"আমি বুঝলাম না,আমাকে কেন অজ্ঞান করল?"
"তুমিই তো সত্য উদঘাটনের পেছনে লেগেছ,তুমিই তো তাদের জন্য বিপদ!"
রশ্নী চোখ বন্ধ করে বালিশে মাথা রাখে। মাথা ব্যথাটা আবার বাড়ছে।দুমিনিট অপেক্ষা করে বলল,
"তারমানে শিখা মিথ্যা বলেনি?"
"না। ও এসবের সাথে জড়িত না"
"কিন্তু ওকে যে গ্রেপ্তার করলেন? অন্য লোক দুটোকে পাওয়া যায়নি?"
"না,তুমি যখন অজ্ঞান হয়ে গেছ,তখনই সম্ভবত ওরা আমাদের বেরিয়ে আসা দেখে গা ঢাকা দিয়েছে"
"এখন কি শিখাকে রিমান্ডে নিবেন?"
"হয়ত না... তবে ওর পরিবারের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারী হয়ে গেছে। ইন্ডিয়ান এম্বাসী হস্তক্ষেপও করেছে।"
"আচ্ছা,ওদের বিচার হবে?"
তুহিন শ্রাগ করে,
"আমাদের দেশের নাগরিকদেরই বিচার নেই, যে সে যখন তখন মারা যাচ্ছে,অন্য দেশীদের কি বিচার করব আমরা? কি বলেন মাশরুক ভাই? আপনারা আইনের মানুষরা তো এসব স্বীকার করবেন না,কিন্তু এটা তো মিথ্যা নয়।আমরা মিডিয়া তো মিথ্যা বলি না!"
"মিডিয়া সত্যও বলে না তুহিন। এখন একটা ভয়ানক অন্ধকার যুগ চলছে। এই যুগে শুধু আইন না, মিডিয়াও প্রতি সেকেন্ডে বিক্রি হচ্ছে।সেই সাথে বিক্রি হচ্ছে আমাদের সবার বিবেক।"
ওরা তিনজন চুপ করে আছে।ওদের সবার মনেই প্রশ্ন, এরপর কি হবে?
............
দুদিন পর রশ্নী শিখার সাথে দেখা করতে যায়। ওকে স্পেশাল সেলে রাখা হয়েছে।এখানে শিখাকে বিশেষভাবে খেয়ালে রাখা হচ্ছে,ওর যেন সমস্যা না হয় সেটাই দেখা হচ্ছে। তুহিনের কথা সত্যি,যেখানে আমাদের বিচার হয় না,সেখানে কোন বিদেশীর কি বিচার হবে? ওর পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা পালিয়ে আছে,তাদের বাংলাদেশে বসবাস ও ব্যবসা সবকিছু আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে ওদের কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে ইতিমধ্যে সবাই সীমানা পেরিয়ে গেছে,সবাই ধরা ছোঁয়ার বাইরে। শিখাকেও দু একদিনের মাঝেই ইন্ডিয়ান পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
রশ্নীকে দেখে শিখা স্মিত হাসে।
"কেমন আছো?"
"দেখতেই পাচ্ছেন!"
"আমি দুঃখিত, আমি চাইনি তোমার কিছু হোক"
"উলটো বলছেন,আমিই দুঃখিত।আমি খেয়াল করিনি যে আমার পেছনে লোক লেগেছে। আমার আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল"
"কি হবে এখন? তোমাকে কি বিচারের আওতায় নিবে ভারতে যাওয়ার পর?"
"জানি না। আমি তো কিছুই করিনি। যারা করল,তাদের কিছুই হবে না হয়ত,মাঝখান থেকে আমার জীবন নষ্ট হবে"
"শিখা,আমি..."
"প্লিজ,ডোন্ট বি সো হাম্বল। আমি ঠিক আছি। একটা অনুরোধ রাখবেন?"
"এনিথিং ফর ইউ"
"দিদির মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মত আগলে রাখবেন? দিদি ওকে যতবার নিজের কাছে রাখবে বলত,ততবার মার খেত। ওর জেদের কারণেই ওকে মরতে হয়েছে। দিদির মত আপনিও ওর জন্য এতটা করলেন। শুধু ওর জন্য কত ঝুঁকিই না নিলেন! আমরা তো মানুষ হয়েও ওকে এতটুকু ভালোবাসা দিতে পারলাম না।আপনি কি আমাদের হয়ে,আমার দিদির হয়ে ওকে ভালোবাসবেন? ওর মা হবেন?"
রশ্নীর চোখ পানি জমেছে। লোহার শিকের ওপাড়ে দাঁড়ানো মেয়েটার চোখে বেয়ে পানি পড়ছে,তবে তার হাস্যোজ্জ্বল মুখটুকু দেখে বোঝার উপায় নেই এ কিসের পানি; বোনকে হারিয়ে কষ্ট পাচ্ছে,নাকি নিষ্পাপ প্রাণের জন্য একটা নির্ভরশীল আশ্রয় পেয়ে আনন্দিত হয়েছে। রশ্নীও কিছু বলতে পারেনি,শুধু ঠোঁট টিপে ইশারা করে,শিখাকে আশ্বস্ত করে। শিখা না বললেও কি রশ্নী পারত এটুকুন মানুষটাকে অন্য কারো হাতে দিতে?
চলবে...
#AbiarMaria
***আগামী পর্বে সমাপ্য***
Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top