৩৫

#অভিসারক_ও_অভিসারিণী
লেখা #AbiarMaria

#৩৫

ফারহার কানে একের পর এক মিসাইল হামলে পড়ছে। মনে হচ্ছে ওর মায়ের পাঠানো মিসাইল গুলো ওর কান ভেদ করে ব্রেইন ফাটিয়ে দিবে। আগেও যেহেতু মায়ের সাথে সাথে উত্তর দিয়ে গেছে, এবারও ফোনের মাঝে প্রতিটা মিসাইল বেট বল দিয়ে পেটাতে থাকলো, যেন সেঞ্চুরি হাঁকানো এক তুখোড় ক্রিকেটার!

ঠিক তখনই, হ্যাঁ, ঠিক তখনই ফারহার বাবা তার স্ত্রীর কান থেকে ফোন কেড়ে নিলেন। তার গমগমে কন্ঠস্বরকে উপেক্ষা করার শক্তি তার মেয়ের নেই। গম্ভীর কন্ঠে সমস্ত রাগ ঢেলে বললেন,
"দুনিয়াতে তুই আসছিসই বাবা মাকে জ্বালায় পোড়ায় অঙ্গার বানানোর জন্য! দুই পরিবারের সবাই মিলে সুন্দর করে সব ঠিক করার পরও তুই রাজি হসনি। তখন জামানকে নিয়ে যা তা বলছিস। এখন এক মাসে হুট করে এই ছেলে ভালো হয়ে গেল? তার সব দোষ গায়েব? চরিত্র ফকফকা?!"

ফারহা ওর বাবাকে কি বলবে? জামানের সাথে এক বাসায় থেকে থেকে তার ভেতরের সৌন্দর্য দেখেছে? জামানের গায়ে ভরভরিয়ে বমি করেছে আর জামান সেসব পরিষ্কার করেছে? জামানের সাথে এত দিন বিয়ে না করে থেকেও জামান ওর সাথে খারাপ কিছু করেনি? বরং নিজে থেকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে যেন ওদের মাঝে হারাম কিছু না হয়? আর বিয়ের পর অকল্পনীয় ভালোবাসার চাদরে জড়িয়ে রেখেছিল? এসব বলা যাবে?

ফারহা কিচেনের স্লাবে হেলান দিয়ে এক পায়ে ভর দিয়ে আরেক পায়ের আঙুল দিয়ে মাটিতে এলোমেলো আঁকিবুঁকি করছে। ওর বাবা ওদিক থেকে বকেই যাচ্ছে। ফারহা শেষ পর্যন্ত না পারতে বলল,
"আব্বু, দেখেন, আমি এখানে মিথ্যা বলে আসিনি। এখানে আমি সত্যি সত্যি ঘুরতে এসছি। কিন্তু এখানে আসার পর জামান ভাই আমার অনেক খেয়াল রেখেছেন। আমি ভেবেছিলাম উনি প্রতিশোধ নিবেন, কিন্তু নেননি। উনি অনেক হেল্পফুল ছিলেন আমার প্রতি। পরে নিজেই বিয়ের প্রস্তাব দেন। আমি বলেছি, আমার বাবা মাকে বলতে হবে। কারণ আগে আমি সবাইকে কষ্ট দিয়েছি, এখন আর পারব না। আপনি বিয়ে করতে চাইলে উনাদের বলেন। এজন্যই আজকের এই আয়োজন"

এক নিঃশ্বাসে ফারহা পুরো মিথ্যা বলল। না, পুরোটা মিথ্যা না, আংশিক মিথ্যা। ফারহার বাবা একটা বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
"এখন কোথায় তুমি?"
"জামান এর বাসায়। মানে জামান ভাই আর কি...!"
ফারহার নিজের মাথায় নিজেই বারড়ি দিতে ইচ্ছা করছে। জামানকে নাম ধরে ডাকতে ডাকতে এখন সবার সামনে সেটাই চলে আসছে। আর যাইই হোক, বাবার সামনে এসব নির্লজ্জতা দেখালে পিঠের চামড়া তুলে দিবে! অবশ্য তাতে কি? দুদিন বাদে তারাই তো বিয়ে দিবে! ফারহার ভাবনার মাঝে ওর বাবা বললেন,
"এক্ষুনি ঐ বাসা থেকে বের হও, আর নিজের যায়গায় যাও!"

খট করে তিনি ফোন কেটে দিলেন। ফারহা মুখ ভেঙচে মনে মনে নিজের ভাগ্যের পিন্ডি চটকাচ্ছে। ঠিক তখন জামান ঘরে প্রবেশ করল। জামানকে দেখে ফারহার সারা শরীরে যেন আগুন ধরে গেছে! ও কোমরে হাত দিয়ে চোখ লাল করে বলল,
"মাথায় কি বেশি বুদ্ধি তোমার? আমার বাবা মার কাছে গালি খাওয়ায় খুব খুশি হইছ নিশ্চয়ই?!"

জামানের বিরক্ত লাগছে। সে কপাল কুঁচকে বলল,
"বারবার এক কথা বলবা না! তুমি যদি আমাকে তিন বছর আগে বিয়ে করতা, তাহলে এত ঝামেলা হত না"
"ও ও ও! আমার দোষ সব এখন? নিজের কোনো দোষ নাই?! তখন আমাকে অবহেলা করছিলা, সেসব স্মৃতি মাথা থেকে চলে গেছে?!"
"হ্যাঁ করছি। কিন্তু তুমিও তো আমাকে এক্সপ্লেইন করার সুযোগ দাও নাই! আমার কথা গুলো একবার বসে শোনার বা বোঝার চেষ্টা কর নাই!"
"কেন করব?! আমি যে এত বার প্রপোজ করলাম, তখন তুমি আমাকে পাত্তা দিস? পেটে পেটে পিরীতি ঠিকই ছিল, মুখে ছিল লঙ্কা! আমাকে আই লাভ ই টু বললে কি সুনামীতে দুনিয়া ধ্বংস হতো?!"
"সুনামীতে দুনিয়া না, আমি ধ্বংস হতাম! তখন আমার প্রেম পেয়ে আপনি আকাশে উড়া শুরু করতেন! আর যখন আকর্ষণ শেষ হয়ে যেত, আমাকে ফেলে দিতেন!"

ফারহা আর জামান তাদের অতীত বর্তমান নিয়ে ঝগড়া করে যাচ্ছে। ফারহা গলার রগ ফুলিয়ে তেজ দেখাচ্ছে, জামানও এক পাও পেছানোর পক্ষে না। যেহেতু ঘরের দরজা খোলা, তার সামনে দিয়ে জন যাচ্ছিল। তার হাতে কফি। নবদম্পতিকে দেখে সে হাসিমুখে বলল,
"এনিওয়ান ওয়ান্ট কফি?"

"নো!"
ফারহা আর জামান দুজনে এক সাথে জনের দিকে ফিরে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল। জন হাত তুলে সারেন্ডারের ভঙ্গি করে সরে গেল। ঠোঁট ডান গালের দিকে প্রসস্ত করে হাসিটা বিস্তৃত করে বিড়বিড় করল,
"পোর লুজার এশিয়ান কাপল!"

ঐদিন রাতে এবং পরদিন সকালে, এমনকি সারাদিন ফারহা একবারও জামানের সাথে কথা বলল না। বকা খেয়েছে বলে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে আছে, ওদিকে জামানও ইগো ধরে রেখেছে। ফারহাকে কয়েকবার বুঝিয়েছে যে, ও ফারহাকে নিয়ে থাকতে চায়। স্বামী স্ত্রী হয়েও দুজনকে দুই ঘরে, দুই বাসায় ঘুমাতে হবে, চুরি করে এক অপরকে দেখতে হবে, এসব মানতে পারবে না। তাই সে চেয়েছে সবাইকে বিয়ের ঘটনা জানিয়ে দিতে। এতে বাংলাদেশে যাওয়ার পর কেউ প্রশ্ন করবে না, বাঁধা দিবে না। অথচ ফারহা পুরো প্ল্যান বানচাল করে দিল! নাহয় ওর বাবা মায়ের রাগ একটু বেশিই, ফারহারও তো এখানে দোষ আছে। তাদের রাগ হওয়াও তো ভুল কিছু না! তাই আজ হোক আর কাল, তাদের রাগের বহিঃপ্রকাশে যা হবে, সেটা তো ফারহাকে ফেইস করতেই হবে! তাহলে যা কাল হওয়ার কথা, তা আজ কেন হবে না? হলে সমস্যা কোথায়? এদিকে জামানের হাতে যে মাত্র হাতে গোণা কয়েকদিন, এসব ক ফারহা বুঝে?! চোখের পলকে আমেরিকা ফিরে আসার সময় চলে আসবে! তখন কি ফারহার আফসোস হবে না?!

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে জামানও ফারহার সাথে কথা বলল না।

শেষ পর্যন্ত যখন রাত হলো, তখন ওর খারাপ লাগা শুরু হলো। আজকের রাতটাই তো এখানে কাটানো হবে, এরপর বউকে তো আর এতটা একান্তভাবে পাওয়া হবে না। বাংলাদেশে যাওয়ার পর কবে নাগাদ ওরা এক ঘরে থাকতে পারবে, আবার এই দেশে কবে আসবে, সহীহ সালামতে দেশে গিয়ে আবার এখানে আসতে পারবে কিনা, কে জানে এসব? বিছানায় শুয়ে জামানের বিচ্ছিন্ন চিন্তাগুলো ওকে যন্ত্রণা দিতে শুরু করল। ফারহা এখনো শুতে আসেনি। খাওয়া শেষে ডিশ ওয়াশ করে ও টয়লেটে গিয়েছিল হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতে। কিছুক্ষণ পর ফারহার পায়ের শব্দ পেয়ে জামান ঘুমের ভাণ ধরে শুয়ে থাকলো।

ফারহা ঘরে প্রবেশ করে দেখল, জামান ঘুমুচ্ছে। এই লোক তো এত তাড়াতাড়ি ঘুমায় না, আজ হঠাৎ? ফারহার মনটাও খারাপ হয়ে গেছে। ভেবেছিল, আজ রাত কিছুটা স্পেশাল হবে। নিউইয়র্কে কাটানো শেষ রাত৷ আগামী রাতে ওরা ব্যস্ত থাকবে প্যাকিং করে বাংলাদেশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। খুব কি দরকার ছিল আজ এত দ্রুত ঘুমানোর? 

গভীর অভিমান নিয়ে ফারহা আলো নিভিয়ে বিছানার অন্যপাশে শুয়ে পড়লো। গুনগুন করে গাইলো,
"পাছ আয়ে,
দুরিয়া ভি কাম না হুয়ি
এক আধুরি সি হামারি কাহানী রাহি..."
অভিমানে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কোল বালিশ টেনে নিতে গিয়ে খেয়াল হলো, জামান নড়ে উঠেছে। ফারহা গান থামিয়ে চুপ করে থাকলো। জামানের দুই হাত কয়েক সেকেন্ডের মাঝে ওর কোমর জড়িয়ে ধরল।

"এত রাগ আমার উপর? কথা বলবা না আর?"

ফিসফিস করে বলা শব্দ গুলো ফারহার কর্নপটে যেন আঘাত করেনি, তবে তা ওর হৃদয়ে ঠিকঠাক পৌঁছেছে। অভিমান কিছু বলতে না চাইলে জামান আবার একইভাবে বলল,
"আজকে রাতটাই তো। তারপর কি হবে আমরা তো জানি না। যদিও আশা করি সব ঠিক হবে। তবুও..."
"তোমার পরিবার কষ্ট পাবে, আমার পরিবার তো কষ্ট পেয়েই গেছে। সব দোষ আসলে আমার, কারও যোগ্য হতে পারলাম না, তোমারও না। কিছুই দিতে পারিনি সবাইকে কষ্ট আর যন্ত্রণা ছাড়া"

জামান ওকে ধরে নিজের দিকে ফিরালো। মুখের উপর চলে আসা চুলের গোছা কানে গুঁজে দিতে দিতে বলল,
"বারবার না বলেছি এসব না বলতে? আমি তোমাকে নিয়ে সুখে আছি, সুখেই থাকব। শুধু আমার সাথে ঝগড়া না করে ভালোবাসতে হবে"

অন্ধকারে ফারহা হাসলো কিনা বোঝা গেল না। ফারহা অবশ্য হাসেনি। সে চুপ করে আছে। জামান নরম স্বরে প্রশ্ন করল,
"মা বাবা কি আজকেও বকেছে?"
"নাহ"
"তাহলে?"
"উনারা আমার কথা বিশ্বাস করেনি। তাদের ধারণা, আমি মিথ্যা বলে এখানে এসেছি। আবার এটাও তাদের ধারণা যে, আমি তোমার জীবনে ভবিষ্যতে কষ্টের কারণ হব। আমি তোমার যোগ্য না৷ তারা সত্যটা না জানলেও তারা যা ভাবছে, তা তো  আর মিথ্যা না!"

"দেখ, সত্য মিথ্যার ব্যাপার না। উনারা বাবা মা, উনাদের আমাদের কাছে কত আশা তো থাকেই। এজন্য এরকম রিএকশন দিয়েছে। দেশে গেলে দেখবা অনেক আদর করবে, ভালবাসবে। শুরুতে এরকম এক আধটু সব বাবা মাই করে। এখন বলো, এসব ভেবে কি আজ রাত নষ্ট করবে?"
"জানি না, ভালো লাগছে না"

ফারহা অন্যদিকে ফিরতে চাইলেও জামান দিল না। দুহাতে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরল।
"ওদিকে ঘোরা যাবে না। আজকে অনেক অনেক ভালোবাসব। ভুলে যাও কাল কি হবে, ভুলে যাও গতকাল কি হয়েছিল। চলো, আরেকটা বেস্ট নাইট ক্রিয়েট করি আমরা। লেটস মেক লাভ!"

ফারহা আবিষ্ট হয়ে জামানকে দেখছে। আবছা আলোয় জামানের মুখাবয়ব বোঝা না গেলেও ওর কন্ঠের মাদকতা, মুখভঙ্গি সব সে বুঝতে পারছে। জামানের ভালোবাসাত ডুবতে ডুবতে ভাবলো, বাংলাদেশে যাওয়ার পর যদি ওর বাবা মা ধরে মারেও, সে মার খেতেও ও রাজী। এত ভালোবাসে যে মানুষ, তার জন্য এটুকু করা যায়! কি আলতো করে ওকে ধরে রাখে, যেন একটু আঘাত দিলেও ও ভেঙে যাবে। পাগলের মত ভালোবাসে ওকে! ফারহার চোখের কোণে পানি জমে।

এমন একটা মানুষের জন্য পৃথিবীর সবার গালি মাথায় নিতেও সে রাজী!

চলবে...

Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top