জীবন আমাদের নানান দিক যে নিয়ে যায়


I've decided to write this story in Bangla, because I believe it wouldn't stay true to its source if I wrote it in English. I apologise to anyone reading this who isn't from Bangladesh!

আজ ১৭ই জুলাই। আমার এইচ.এস.সি. পরীক্ষার আর মাত্র ১ মাস বাকি। স্বাভাবিকভাবেই আমার দিনকাল চলে শুধুমাত্র বই বা গাইড এর ভেতর মাথা গুঁজে। তবে জীবনকে আর থামায় কে? গতকাল আমার সাথে এমন এক ঘটনা ঘটলো, আমি বুঝলাম আমি তা না লিখে থাকতে পারবো না।

আমি কাহিনীতে অগ্রসর হওয়া পূর্বক বলে রাখতে চাই একটিমাত্র কথা। আপনারা যে-ই এই লেখাটি পড়বেন, অনুগ্রহ করে আমার বাংলা ভাষাগত দক্ষতা মাফ করে দিবেন।  আমি বাংলায় যতই না কম কথাবার্তা বলি, তার চেয়েও কম লেখালেখি করি। 

এই বড় লজ্জার কারণেই ১৬ই জুলাই সকালে আমার স্থান ছিল কলেজের প্রায় জনশুন্য পরীক্ষাকক্ষে। পরীক্ষাটি ছিল বাংলা ২য় পত্র মডেল টেস্ট। আমার সহপাঠীরা আমার মতো হোপলেস নয়, তাদের ঠিকই বাংলা ভাষায় দক্ষতা রয়েছে। তারা বাংলা ২য় মডেল টেস্ট না দেওয়ার সিদ্ধান্তেই আমি নিজেকে খুজে পেলাম সেই জনশুন্য কক্ষে। 

যাই হোক, আমার পরীক্ষা যেমন যাওয়ার তেমনই গেল। গ্রীষ্ম শব্দটির উচ্চারণ গ্রিশ্‌শোঁ, পথভ্রষ্ট শব্দটির ব্যাস বাক্য পথ থেকে ভ্রষ্ট এবং এর সমাস ৫মী তৎপুরুষ - আমি যা যা পারি লিখে দিয়ে আসলাম। পরীক্ষা মোটামুটি কঠিনই হয়েছিল। তবে তাই বলে আমি খুশি হলাম এই চিন্তায় যে আমার পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।

আমার কলেজ এর পথ আমার বাসা হতে অনেক দূর। প্রথমে ট্যাম্পো করে অর্ধেক পথ অতিক্রম করতে হয়, এরপর রিকশা ভাড়া করে বাকি অর্ধেক। আমি দ্রুতই কলেজ ক্যাম্পাস ত্যাগ করে ট্যাম্পোতে উঠে গেলাম, বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার পড়তে বসতে হবে চিন্তায়।

ট্যাম্পোর যাত্রাটি প্রকৃত পক্ষে দীর্ঘ হলেও আমার মনে পরীক্ষার প্রশ্নসমূহ ঘুরতে ঘুরতেই আমার সময় কেটে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্যাম্পোটি তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যায় এবং আমি নেমে যাই। ট্যাম্পোর ভাড়াটি দিয়েই আমি আমার বাকি অর্ধেক পথ যাত্রার জন্য রিকশা খোজার শুরু করি।

কিছু পথ সামনে আগাতেই একটি খালি রিকশা সামনে পরে। আমি আমার স্বাভাবিকভাবেই রিকশাওয়ালাটিকে ডাক দিলাম-

"যাবেন? সুগন্ধা ১ নম্বর রোড।"

রিকশাওয়ালাটি আমার দিকে ফিরলেন। দেখলাম তিনি ছিলেন মধ্যবয়স্ক - তার চোখের নিচে বয়সের ভার এবং মুখে অল্প আধপাকা দাড়ি। তিনি বললেন -

"জি, আসেন।"

"কত নিবেন?" আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

উনি অল্প একটু হাসলেন। এরপর তিনি শুদ্ধ বাংলায় উত্তর দিলেন - 

"এটি আর বলতে হয়? আপনাদের সাথে কথা বলাটাই তো..." - উনি আর বললেন না।

আমি তেমন একটা কিছু বুঝলাম না। আমার আসলে বেশি নেগোশিয়েশন ভালো লাগে না। অত্যাধিক ভাড়া না হলে হাসিমুখে দু একটা কথা বললে মেনে নেই। এবারও তাই করলাম -

"আচ্ছা চলেন," বলে উঠে গেলাম রিকশায়।

উনি যাত্রা শুরু করলেন। আমার মন আবারও পরীক্ষার প্রশ্নের প্রতি ফিরে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে যখন উনি হঠাৎ অল্প পেছন ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন -

"আপনি কি ক্যান্টনমেন্ট পাব্লিকের ছাত্র?"

আমি আমার মন থেকে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসতে একটু সময় লাগলো। এরপর আমি উত্তর দিলাম -

"জি।"

"জুলফিকুর হাসান (নাম পরিবর্তিত) কে চিনেন?"

জুলফিকুর হাসান ছিলেন আমাদের কলেজের একজন শিক্ষক। তার সাথে আমার বিশেষভাবেই পরিচিতি ছিল, তাই তার নাম শুনে মনে মনে একটু খুশিই হলাম। বললাম -

"জি জি, উনি অনেক ভালো ক্লাস নেন।"

এরপর তিনি আর কিছু বললেন না। আবারও নীরবতায় যাত্রা চালিয়ে যান।

আমি সাধারণত চুপচাপ প্রকৃতির মানুষ। বন্ধুবান্ধব বা আপনজন ব্যতীত অন্য কারো সাথে আমার তেমন কথাবার্তা হয় না। তবে আমি ভাবলাম, এই সময়ে আমার কিছু একটা বলা উচিত। আমি কিছুক্ষণ ভেবেচিনতে বললাম -

"আপনি কি ওনাকে চিনেন?" জিজ্ঞাসা করলাম।

তিনি উত্তর দিলেন -

"জি, উনি আমার বড় ভাই।" 

আমি খানিকটা চমকে উঠলাম। আমার ঘরোয়া মনে কিছু আসলো না বলার। যাত্রাটি আবারও ফিরলো নীরবতায়।

কিছুক্ষণ পর তিনি নিজের থেকেই অল্প মুচকি হাসি হেসে বললো -

"ও সবসময় পড়ালেখায় ভালো ছিলো। ও আমার ৩ বছরের বড়। যদিও আমার বিয়ে হয়েছিল তার ৮ বছর আগে।"

"ও আচ্ছা" ছাড়া আমি তেমন কিছু একটা বলতে পারলাম না।

এরপর উনি যোগ করলেন -

"অনেকদিন বাসায় যাওয়া হয় না।"

আমি আবারও কিছু বলতে ব্যর্থ হলাম। মনে "কেন?" প্রশ্ন জাগলেও প্রশ্নটি ইনসেন্সিটিভ হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আর জিজ্ঞাসা করলাম না।

"ওনার বাসা তো মনে হয় ভুইয়া গলির দিকে এখন," তিনি বললেন।

আমি আবারও কি বলবো না বুঝে বললাম -

"অতটুক আর বলতে পারবো না আমি।"

আবারও নীরবতায় ফিরল যাত্রাটি। কয়েক মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি অল্প একটু হেসে কঠোর কণ্ঠে বক্তব্য রাখলেন -

"আমি পথভ্রষ্ট হয়েছি আরকি।"

এই বক্তব্যের আগ পর্যন্ত আমাদের সম্পূর্ণ কথোপকথনটি অনেকটা এই বিষয় নিয়ে হলেও আমি নিশ্চিত ছিলাম না এই বিষয়টি নিয়ে কিভাবে আমার আগানো উচিত বা আমার আগানো উচিত ও বা কিনা। কিন্তু তার এই আন্তরিক স্বীকারোক্তিটি আমার মনের সহমর্মিতাটিকে জাগিয়ে তুলে। আমার এই বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস এর কারণে আমি সামান্য উৎকণ্ঠে বলে উঠলাম -

"আপনি এ রকম বলেন না। আমাদের জীবন একেক জনের এক এক রকম।"

এই কথায় ওনার অনুভূতিসমূহ আর জানতে পারলাম না, কারণ এবার যাত্রাটি আমাদের নীরবতা থেকে আর ফেরত আসলো না।

আমার বাসায় পৌঁছে রিকশা থেকে নেমে যাই। ভাড়া দেওয়ার সময় দেখলাম যে আমারও ভাঙটি নেই, তারও ভাঙটি নেই। আশেপাশে কেউ নেই বলে আমার দুঃখবসত তাকে রেট ভাড়ার চেয়ে ১০ টাকা কম দিতেই বাধ্য হলাম, কিন্তু তিনি কোনো আপত্তি করলেন না। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম - আমাদের শেষ কথার পরবর্তী থেকে আমার মনে যা চলছিল, আমার তা তাকে বলা উচিত। আমি একটু সাহস করে তোতলায় তোতলায় বললাম -

"শুনেন, আপনি নিজেকে নিচু চোখে দেখেন না। আপনিও কিন্তু কারো থেকে কম নও।"

এটি শুনে তার মুখে আবারও অল্প একটু হাসি ফুটে উঠলো। আমার তার চেহারা দেখে মনে হলো যেন তার চোখের নিচের ভার অনেকটুকু হ্রাস পেয়েছে। তিনি বললেন -

"আসলে আমার ব্যবসা ছিল প্রায় ৪০ লাখ টাকার। তাতে মারা খেয়েছি বলেই আমার আজ এই অবস্থা। না হয় আমিও তো আপনার মতো ইন্টার পাস।"

আমি শুধু মাত্র ওনার কথায় কান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং "জি" ছাড়া আর কিছু বললাম না।

"বাসায় আর যাই না অনেক দিন হচ্ছে... শরম লাগে," তিনি বলতে লাগলেন। এবার আমি সিদ্ধান্ত নিলাম কেন জিজ্ঞাসা করার। তিনি আরও বললেন -

"আমি তার ৮ বছর আগে বিয়ে করেও আজ আমার এই অবস্থা। আর আসলে এখন আমাদের সমাজ তো আলাদা," তিনি সামান্য কোমল কণ্ঠে বলেন।

আমি আচ্ছা বললে তিনি আরেকটু বললেন -

"আর আমি যে মেয়েকে বিয়ে করেছিলাম, সে ছিল হিন্দু পরিবারের। বাসায় সে..." তিনি আর বললেন না।

এটিতে আমি আবারও একটু চমকিত হলাম, কিন্তু এবার সম্মানবসত।

আমাদের কথোপকথন এর মাঝখানেই আরেক জন ব্যক্তি এসে তাকে ভাড়া নেওয়ার জন্য তার সাথে কথা বলতে শুরু করে। তো আমি আর বেশি দেরি না করে তাকে এক ফাঁকে আবারও তোতলায় তোতলায় বললাম - 

"আপনি নিজের উপর আস্থা রাখেন। আপনিই আপনার জীবনটিকে সুন্দর করে তুলতে পারবেন ।"

তিনি অত্যন্ত সুন্দর একটা হাসি দিলেন এবং "আচ্ছা, দোয়া করিয়েন।" বলে আমার থেকে বিদায় নিলেন।

এতে আমার মনে এক প্রকার শান্তি আসলো। আমি একটু হলেও হয়ত ওনাকে সাহায্য করতে পেরেছি। কিন্তু বাসার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আমার মনে সম্পূর্ণ ঘটনাটির নাটকীয়টাই খেলা করছিল।

আমি বাসায় এসে দেখলাম আমার বোন ডাইনিং টেবিল এ বসে আছে এবং আমার মা রান্নাঘরে কাজ করছে। আমি আর পারলাম না, তাদেরকে ডাইনিং টেবিলে একসাথে বসিয়ে সম্পূর্ণ ঘটনাটি বর্ণনা করলাম। তারাও পুরো ঘটনাটি শুনে বেশ মজা পেল।

তারা মতামত পেষণ করলো -

"হ্যা, তিনি নিজে ঠিকই বলসিলেন, তিনি শুধুমাত্র পথভ্রষ্ট বা মিসগাইডেড হয়ে গেছে আরকি।"

আমি দ্বিমত পেষণ করে আমার মনের কথাটাই বললাম - 

"আমার মনে হয় না, তিনি অনেকটা নিজের পথ নিজেই বেছে নিয়েছেন, আর এজন্য আমার ওনার প্রতি শুধুমাত্র সম্মানই আছে। এটা শুধুমাত্র ভাগ্যের পরিহাস যে আজকে ওনার অবস্থা এরকম।"

কিছুক্ষণ ভেবে আমার মা এবং আমার বোন ও একমত হলেন যে "হ্যা, তাও ঠিক।"

আমি বলতে লাগলাম - 

"আমি খুব সহজেই ভবিষ্যতে ওনার মতো অবস্থানে থাকতে পারি।"

এই কথাটি আমার কাছে যততাই না ভীতিকর, এটি তততাই মুক্তিদায়ক। ভবিষ্যতে জীবন আমাকে যেখানেই নিয়ে যাক না কেন, তার মধ্যে আমি আমার নিজের পথ খুজে নিবো, এবং তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করবো। এছাড়া অন্য কোনোভাবে সুখী জীবন কাটানোর কোনো পথ দেখি না আমি।

  


Bạn đang đọc truyện trên: AzTruyen.Top